বাণিজ্যিক ভাবে উন্নত জাতের হাইব্রিড পেঁপে চাষ করে অনেক বেকার যুবক জীবিকা নির্ভর করছে এবং অন্যদের কাজ করতে সুযোগ দিয়ে বেকাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দিচ্ছে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ভাবে উন্নত জাতের হাইব্রিড পেঁপে চাষ করে অনেক লাভবান হওয়া সম্ভব। কিন্তু পেপে চাষ করার আগে চাষিকে অবশ্যই আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ পদ্ধতি ও জাত সমূহ সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। এছাড়া তাকে খিয়াল রাখতে হবে যে কোন পেপে রোপন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাই পেঁপে গাছ লাগানোর আগে আপনাকে যে বিষয় খিয়ল রাখতে হবে চলুন তা এক এক করে জেনে আসি,
আমাদের দেশে পেঁপে একটি দারুণ জনপ্রিয় ফল ও স্বাস্থ্যকর ফল। এই পেঁপের বৈজ্ঞানিক নাম হল, Carica papaya এবং আরো নাম আছে যথা,এর ইউনানী নাম পাপিতা, আরানড খরবূযা। এবং আয়ুর্বেদিক নাম অমৃততুম্বী। পেপে ফলটি মানুষ কাঁচা তথা সবুজ অবস্থায় সবজি হিসেবে এবং পাকা অবস্থায় ফল হিসাবে খেয়ে থাকে। এই পেঁপে আছে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ ছাড়াও এতে অনেক পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘পেপেন’ রয়েছে এবং এর অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে।
পেঁপে চাষ করার পদ্ধতি
পেঁপে একটি স্বল্পস্থায়ী ফল এবং এর চাষের জন্য খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। আঙিনায় দুটি গাছ লাগালে সারা বছরই সবজি ও ফল পাওয়া যায়।পেঁপে চাষ লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন বাণিজ্যিকভাবে পেঁপে চাষ করছেন। কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ না করায় কৃষকরা তেমন ফলন পাচ্ছেন না। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ভাবে উন্নত জাতের হাইব্রিড পেঁপে চাষ করে দ্বিগুণ ফল পাওয়া সম্ভব। এছাড়া পেঁপে পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং এটি মানবদেহে রোগ প্রতিরোধে কাজ করে থাকে।
কোথায় কোথায় পাওয়া যায়ঃ আমাদের দেশে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পেঁপের চাষ করা হয়।
পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি
পেঁপে চাষ করতে গেলে আপনাকে আগে বাণিজ্যিক ভাবে উন্নত জাতের পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে, তানাহলে আপনি পেঁপে চাষে লাভবান হতে পারবেনা। তাই আপনাকে পেঁপে চাষ করতে হলে প্রথমে উন্নত জাতের হাইব্রিড পেঁপে চাষ পদ্ধতি, বাণিজ্যিক ভাবে পেঁপে চাষ, উপযুক্ত জমি ও মাটি তৈরী,জাত পরিচিতি, পেঁপে চারা রোপণ, সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা, পেঁপে গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি, পেঁপে গাছ রোপনের সময়, পেঁপের জাত সমূহ ও পেঁপে তোলা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
উপযুক্ত জমি ও মাটি নির্বাচন : পেঁপে চাষের জন্য জমি হতে হবে উচু বা মাঝারি উঁচু, যাতে জমিতে পানি না বাধে। পানির অপর নাম জীবন কিন্তু বেশি পানিদিলে পেঁপে গাছের শিকড় পচেযায় তাই ভালোভাবে দেখে উচু জমি নিতে হবে। এছাড়া জমি হতে হবে উর্বার। উর্বর হলে জমিতে ফলন ভালো পাওয়া যায়।
উন্নত জাতের পেঁপে চাষ পদ্ধতি
পেঁপে চাষের জন্য সেরা জাত নির্বাচন
পেঁপের জাতসমূহ: পেঁপে একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই জনপ্রিয়। পেঁপে গাছের বিভিন্ন জাত রয়েছে, যা ফলের আকার, স্বাদ, রঙ এবং ফলনের দিক থেকে ভিন্ন হতে পারে। সঠিক জাত নির্বাচন করলে পেঁপে চাষে ভালো ফলন পাওয়া যায়। পেঁপের কিছু পরিচিত ও জনপ্রিয় জাত নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. রেড লেডিঃ
রেড লেডি পেঁপে একটি জনপ্রিয় জাত, যা চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেশি চাষ করে থাকে। এ জাতের পেঁপে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং গাছ লাগানোর ৫-৬ মাসের মধ্যেই ফল দেয়। রেড লেডি পেঁপের ফল আকারে বড়, আকর্ষণীয় লাল-কমলা রঙের হয় এবং খেতে বেশ মিষ্টি। গাছটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশ ভালো।
২. সিঙ্গাপুর পেঁপেঃ
সিঙ্গাপুর পেঁপে হলো আরেকটি উচ্চ ফলনশীল জাত, যা বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। এ জাতের পেঁপে গাছ মাঝারি আকারের হয়ে থাকে এবং প্রতি গাছ থেকে প্রচুর ফল পাওয়া যায়। ফলগুলো আকারে বড় এবং খেতে মিষ্টি হয়। এ জাতের পেঁপে গাছ দীর্ঘ সময় ধরে ফল দিয়ে থাকে, যা বাজারজাত করার জন্য উপযুক্ত।
৩. হানিটিউ পেঁপেঃ
হানিটিউ জাতের পেঁপে মূলত তার মধুর স্বাদের জন্য বিখ্যাত। এই পেঁপেগুলি আকারে মাঝারি, রঙে হলুদাভ এবং খেতে অনেকটাই মধুর মতো মিষ্টি। পেঁপের এই জাতটি বেশিরভাগ সময় টাটকা খাওয়ার জন্য চাষ করা হয়। ফলের আকার ও স্বাদের কারণে এটি চাষিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি জাত।
৪. কুড়ি পেঁপেঃ
বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের মধ্যে “কুড়ি পেঁপে” একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম। এ জাতের পেঁপে আকারে ছোট এবং স্বাদে কিছুটা টক-মিষ্টি মিশ্রণ থাকে। সাধারণত এই পেঁপে সবজি হিসেবে রান্নার জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়। কুড়ি পেঁপে গাছ খুব বেশি লম্বা হয় না এবং চাষের জন্য তেমন যত্নেরও প্রয়োজন হয় না।
৫. হাওয়াইয়ান পেঁপেঃ
হাওয়াইয়ান পেঁপে হলো আরেকটি বিদেশি জাত, যা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ জাতের পেঁপে আকারে ছোট, ফলের মাংস নরম ও মিষ্টি। এটি প্রধানত রপ্তানির জন্য চাষ করা হয় এবং চাষে দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। গাছটি মাঝারি আকারের এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ভালো।
৬. সোনা পেঁপেঃ
সোনা পেঁপে বাংলাদেশে একটি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাত হিসেবে পরিচিত। এ জাতের পেঁপের ফলগুলো আকারে মাঝারি, রঙে সোনালি এবং স্বাদে মিষ্টি। সোনা পেঁপে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং প্রতি বছর প্রচুর ফল দেয়। এটি স্থানীয় বাজার ও রপ্তানির জন্য সমানভাবে উপযোগী।
পেঁপের জাত নির্বাচনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
পেঁপের জাত নির্বাচন করার সময় মাটির ধরন, আবহাওয়া, এবং চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হবে। কোন জাতটি রোগ প্রতিরোধী, দ্রুত ফলনশীল এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত তা বুঝে চাষ করা উচিত। চাষিদের উচিত বীজতলা থেকে সুস্থ ও রোগমুক্ত জাতের পেঁপে বীজ সংগ্রহ করা এবং গাছের জন্য সঠিক পরিচর্যা করা।
হাইব্রিড পেঁপে চাষ পদ্ধতি
বাণিজ্যিক ভাবে পেঁপে চাষ করতে হলে অবশ্যই হাইব্রিড পেঁপে চাষ করতে হবে। কারণ হাইব্রিড পেঁপে গাছ লাগালে অল্প গাছে বেশি ফল পাওয়া যায়।
পেঁপের চারা তৈরি: পেঁপের চার বীজতলা ও পলিথিন ব্যাগে তৈরি করা যায়। কিন্তু পলিথিন ব্যাগে চার তৈরি করলে রোপণের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই কারনে পলিব্যাগে চারা রোপন করা ভালো। বীজতলায় চারা তৈরির ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার সারি করে প্রতি সারিতে ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে। কিন্তু পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরী করতে হলে প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ রোপনের ১৫ থেকে ২০ দিন পর চারা বের হয় এবং ৪০ থেকে ৫০ দিন পর তা রোপণের উপযোগী হয়।
পেঁপে গাছ রোপনের সময়: পেঁপে বীজ রোপনের সঠিক সময় হলো আশ্বিন এবং পৌষ মাস। পেঁপে চাষ এ সফলতা পেতে ভালো ফল পেতে হলে বীজ বপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুণ মাসে পেঁপের চারা রোপণ করতে হয়। এই সময় যদি পেঁপে গাছ লাগানো হয় তাহলে আশা করি ভালো গাছ ও পেঁপে পাবেন।
পেঁপে চারা রোপণ পদ্ধতি: ভালোপেপে পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই পেঁপে চারা রোপণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। চারা রোপণের আগে ভালো মাটিতে বীজ তলায় উৎপাদিত করতে হবে। এই চারা রোপনের আগে ভালো ভাবে মাটি চাষ দিতে হবে, যাতে করে সারি মাটি ভালোভাবে ওলট-পালট ও ঝুরঝুরে হয়। ত্রিভুজ আকারে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে করে ৩ টি গর্ত করে চারা রোপণ করতে হবে। রোপণ করা চারার মৃত্যু হার হ্রাস পেতে এবং ভালো পুষ্টি চারা পেতে রোপণের আগে চারার উন্মুক্ত পাতাগুলো ফেলে দিতে হবে। এতে করে গাছ ও ফল দুটোই ভালো পাওয়া যায়।
পেঁপে গাছের পরিচর্যা
পেঁপে একটি বহুল পরিচিত ফল যা বাংলাদেশে সহজেই চাষ করা যায়। পেঁপে গাছের পরিচর্যা ও সঠিক চাষ পদ্ধতি মেনে চললে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই, সফল পেঁপে চাষের জন্য চাষিদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা দরকার।
পেঁপে চাষের সময়
পেঁপে চাষের সেরা সময় হলো শীতের শেষ ও বসন্তের শুরুতে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে। এ সময়ে পেঁপে গাছ রোপন করলে গাছ ভালোভাবে শিকড় ধরতে পারে এবং ফলনও ভালো হয়। তবে, উষ্ণ আবহাওয়ায় সারা বছরই পেঁপে চাষ করা সম্ভব।
পেঁপে চাষ পদ্ধতি
পেঁপে গাছ চাষের জন্য প্রথমে মাটি প্রস্তুত করতে হবে। পেঁপে গাছ বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মায় এবং মাটি যেন পানি জমে না থাকে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। চাষের জন্য ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর গর্ত করতে হবে। গর্তের নিচে গোবর বা কম্পোস্ট মিশিয়ে রাখলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। চারা রোপণের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হয় সুস্থ এবং রোগমুক্ত গাছ থেকে। বীজ থেকে চারা উৎপাদনের সময় চারা ১৫-২০ সেমি লম্বা হলে তা রোপণের উপযুক্ত হয়।
পেঁপে গাছের পরিচর্যা
পেঁপে গাছের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষত গ্রীষ্মকালে। তবে গাছের গোড়ায় পানি জমে গেলে শিকড় পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই মাটির ড্রেনেজ ভালো থাকা দরকার। গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। গাছের ডালপালা ঠিকমতো ছাঁটাই করতে হবে, যাতে গাছের উপরিভাগে আলো এবং বাতাস চলাচল করতে পারে। পেঁপে গাছ রোদপ্রিয়, তাই গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রয়োজন।
পেঁপে গাছের সার
সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ পেঁপে গাছের ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গোবর, কম্পোস্ট, বা ভার্মিকম্পোস্টের মতো জৈব সার পেঁপে গাছের জন্য খুবই উপকারী। প্রথম পর্যায়ে চারা লাগানোর সময় প্রতি গর্তে প্রায় ২-৩ কেজি গোবর সার দিতে হবে। তারপর প্রতি ২-৩ মাস পরপর ২০০-২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি, ও এমপি সার গাছের গোড়ায় দিতে হবে। নিয়মিত সারের যোগান গাছের ফলন বাড়াতে সাহায্য করবে।
পেঁপে গাছ রোপণের সময়
পেঁপে গাছ রোপণের সময় বিশেষ যত্ন নিতে হবে। রোপণের আগে চারা গাছের গোড়ায় পলিথিন বা মাটির বলকে ভালোভাবে রাখলে তা সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যাবে এবং চারা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। রোপণের সময় চারা গাছের গোড়া যেন মাটির নিচে বেশি ঢেকে না যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। চারা রোপণের পর প্রথম কয়েকদিন সকাল-বিকেল পানি দিতে হবে, যাতে মাটি শুষ্ক না হয়।
সঠিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করলে খুব কম খরচেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে রোপণ, পরিচর্যা, এবং সারের প্রয়োগ চাষিদের লাভবান করতে পারে। পেঁপে গাছের সঠিক যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে সারা বছর ফল পাওয়া যায়, যা চাষিদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক।