সকল দেশে লাউ অনেক জনপ্রিয় একটি সবজি। লাউ এক প্রকার লতানো উদ্ভিদ যা এর ফলের জন্যে চাষ করা হয়। লাউ পৃথিবীর অন্যতম পুরনো চাষ হওয়া সবজি, এর জন্ম স্থান আফ্রিকাতে। লাউকে কোন কোন স্থানে আঞ্চলিক ভাষায় কদু বলা হয়। কচি লাউয়ের রং হালকা সবুজ, ভেতরে সাদা রঙের হয়ে থাকে। বর্তমান ভালো ফলন পাবার জন্য বারোমাসি লাউ চাষ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটির চাষ সাধারণত শীতকালে ভালো হয়ে থাকে। লাউ, লাউয়ের পাতা ও ডগা শাক হিসেবে খাওয়া যায়। লাউ যেমন সবজি হিসাবে অনেক সুস্বাদু তেমনি লাউয়ের পাতা শাকও অনেক পুষ্টিকর।
রাসুল (সা:) এর প্রিয় খাবারের একটি হলো লাউ। এই লাউয়ের অনেক উপকারিতা রয়েছে। এই লাউ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। শুধু লাউ নয়, লাউয়ের লতা, এমনকি লাউয়ের পাতাও খাওয়া যায়। তাই বর্তমান লাউ চাষ করে অনেক যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাই আপনিও লাউ চাষ করে বাড়ির চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রয় করে বাসার কিছু খরচ কমাতে পারেন। আর বাণিজ্যিক ভাবে যদি চাষ করেন তাহলে নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারেন।
লাউ চাষ পদ্ধতি
লাউয়ের বীজ বপনের সময় কাল: লাউয়ের বীজ বোনার উপযুক্ত সময় কাল হলো আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। তবে ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বীজ রোপন করা উত্তম বলে মনে হয়। কিন্তু ভালো চারা পেতে হলে লাউয়ের বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং সবল সতেজ চারা উৎপাদনের সাবার আগে বীজ শোধন করেনেওয়া জরুরি। বীজ শোধন জন্য ভিটাভেক্স/ক্যাপটান ব্যবহার করাহয়ে থাকে। প্রতি বিঘা জমির জন্য ৭০০-৮০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হয়।
বীজতলার তৈরি: শীতকালে লাউ বীজের বৃদ্ধিতে সমস্যা হয়। এ কারণে শীতকালীন চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ অঙ্কুরিত না হওয়া পর্যন্ত পলিব্যাগ প্রতি রাতে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এবং দিনের বেলা খোলা রাখতে হবে। চারাকে প্রয়োজনমতো পানি দিতে হবে।
জমি নির্বাচন: লাউ ফসল চাষের জন্য ভালো সেচ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধা এবং পর্যাপ্ত সূর্যা আলো যুক্ত জমি নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন করা জমির মাটি এবং গর্ত ভালভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে করে লাউ এর চারা ব্যাপক ভাবে শিকড় বৃদ্ধির করতে পারে। যত ভালো শিকড় দিবে ততো ভালো চারা হবে।
বেড ও মাদা তৈরির নিয়ম :
বেড ও মাদা তৈরি জন্য বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি. এবং বেডের প্রস্থ হবে ২.৫ সেমি.। এভাবে ধারাবাহিকভাবে বিছানা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ২টি বেডের মধ্যে ৬০ সেমি. ফাকা সেচ খাল তৈরী করতে হবে। তারপর মাদার তৈরির জন্য এর আকার ৫০-৫৫ সেমি ব্যাস হবে, গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি এবং নীচে ৪৫-৫০ সেমি হতে হবে। মাদার মাঝ বরাবর ২ মিটার ব্যবধানে সারিবদ্ধভাবে মাদা তৈরি করতে হবে।
লাউ এর জাত সমূহ
আমাদের দেশে অনেক ধরনের লাউয়ের জাত রয়েছে। লাউয়ের ভালো জাতের মধ্যে রয়েছে: হাইব্রিড- মার্টিনা লাউ, ডায়না লাউ, বর্ষা লাউ, তাফসি লাউ, উফশীর লাউ, সবুজ হীরা লাউ, বারি করলা লাউ, শীতকালীন লাউ, ময়না লাউ ও ক্ষেতের দেশি লাউ। এদের আবার বিজ্ঞানিক নাম আছে সেগুলা নিম্নের দেওয়া হলো:
ক্রমিক নং | জাতের নাম | লাউ এর জীবন কাল |
---|---|---|
০১ | বারি লাউ-১ | ১২০-১৪০ দিন |
০২ | বারি লাউ-২ | ১২০-১৪০ দিন |
০৩ | বারি লাউ ৩ | বীজ বপনের ৯০ দিনের মধ্যে ১ম ফল সংগ্রহ করা যায় |
০৪ | বারি লাউ ৪ | বীজ বপনের ৯০ দিনের মধ্যে ১ম ফল সংগ্রহ করা যায় |
০৫ | বারি লাউ ৫ | বীজ বপনের ৯০ দিনের মধ্যে ১ম ফল সংগ্রহ করা যায় |
০৬ | বারি সীতা লাউ-১ | ১০-১৫ বছর |
০৭ | BU লাউ-১ | ৫০-৫৫ দিন |
০৮ | BU হাইব্রিড লাউ-১ | ৫০-৫৫ দিন |
০৯ | বর্ষা হাইব্রিড | ৬০-৬৫ দিন |
Lau Chas Poddhoti
লাউ এর চারা রোপণ পদ্ধতি : লাউ এর চারা রোপণের আগের দিন বিকালে পানি দিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরের দিন বিকেলে চারা রোপণ করতে হবে। জমিতে প্রস্তুত করা মাটি ভালোভাবে উল্টে দিতে হবে। তারপর ব্লেড দিয়ে পলিব্যাগের ভাঁজ বরাবর কেটে পলিব্যাগটি সরিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে চারা রোপণ করে চারপাশে মাটি দিয়ে দিন। পলিব্যাগ অপসারণ এবং চারা রোপণের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত কারণ চারার শিকড়ের ক্ষতির ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে। এছাড়া প্রয়োজনের বেশি পানি দিলে ফলের ধারণ ব্যাহত হবে এবং ফল ধীরে ধীরে ঝরে যাবে। লাউ গাছে শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ৪/৫ দিন অন্তর সার দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
লাউ গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
লাউ এর চারা রোপণের পর প্রয়োজন মত লাউ গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে তানাহলে গাছের ক্ষতি হতে পারে। লাউয়ের চারা লাগানোর ১৫, ৩৫, ৫৫ ও ৭৫ দিন পর ইউরিয়া ও এমওপি প্রয়োগ করতে হবে তাহলে ভালো ফল আশা করে যাবে। সার রোপনের সময় সার গুলি যথাসম্ভব ভাল করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
সারের নাম | প্রতি গর্তে | হেক্টরপ্রতি |
পচা গোবর | ১০ কেজি | ১০০০ কেজি |
ইউরিয়া | ৫০০ গ্রাম | ৫০০ কেজি |
টিএসপি | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ কেজি |
এমওপি | ৩০০ গ্রাম | ৩০০ কেজি |
বোরন | ০২ গ্রাম | ২ কেজি |
ছাদে লাউ চাষ পদ্ধতি
একটি অর্ধেক ড্রামে ১,৫ ইঞ্চি তিনটি গর্ত ড্রিল করতে হবে। তারপর গর্তের উপর একটি ইটের আচ্ছাদন রাখুন যাতেকরে মাটি না ধুয়ে যায়। ২ ভাগ বেলে দোআঁশ মাটির সাথে ১ ভাগ গোবর, ৫০০ গ্রাম সরিষা খৈল, ৫ কেজি পচা কচুরিপানা, ৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে সাত দিন ধেকে রেখে দিন। ৭ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। লাউ গাছটি সঠিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য, একটি মাচার ব্যবস্থা করতে হবে। কেউ ছাদের মেঝেতে লাউ বিছিয়ে দিতে চাইলে নারকেলের খোসা বা কুঞ্ছি বিছিয়ে তার ওপর গাছ বিছিয়ে দিতে পারেন। ছাদে লাউ চাষ করলে গাছে একটু বেশি পানির প্রয়োজন হয় তাই, প্রতিদিন সকাল-বিকাল পানি দিতে হবে এ ছাড়া মাছ-মাংস ধোয়ার পানি দিলে উপকার পাওয়া যায়।
লাউ গাছের রোগ বালাই
লাউ গাছে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। গাছে রোগ হলে পরিপক্ক গাছের পাতায় হলুদ ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা ছোট, বিকৃত এবং নিচের দিকে কুঁচকে যাওয়া। সংক্রমিত ফল বাঁকানো হয় এবং কচি গাছের জটলার লেগে যায়। ফলের উপরের অংশ রুক্ষ হয়ে যায়। লাউ গাছে রোগ হলে গাছের ফলন ও কমেযায়। চলুন লাউয়ের কিছু রোগ সমূহ সম্পর্কে জেনে আসি;
রোগের নাম সমূহঃ
- লাউ এর ডাউনি মিলডিউ রোগ
- লাউ এর পাউডারি মিলডিউ রোগ
- লাউ এর গামী স্টেম ব্লাইট রোগ
- লাউ এর রেড পাম্পকিন রোগ
প্রতিকার ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার রাখা।
২. ক্ষেতে বাহক পোকা উপস্থিতি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।
৩. রোগাক্রান্ত গাছ থেকে কোনো বীজ সংগ্রহ ও ব্যবহার না করা।
লাউ এর ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন
মাছি পোকা নামক একপ্রকার পোকা লাউয়ের ফলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে, পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের ভেতরে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে এর ফলে ফল গুলি নষ্ট ও ক্ষতি হয়ে থাকে। এই মাছি পোকর দ্বারা আক্রান্ত ফল দ্রুত পচে যায় এবং ফল গুলি মাটিতে পড়ে যায়। আক্রান্ত ফল কখনোই মাঠের আশেপাশে ফেলে রাখবেনা। আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে পেলতে হবে তাহলে মাছি পোকার বংশবৃদ্ধি অনেকাংশে কমে যাবে।
লাউয়ের পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
১. চারা অবস্থায আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
২. ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৩. চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখলে এ পোকার আক্রমণ থেকে চারাগুলোবাচানো যায়।
৪. আক্রমণের হার বেশি হলে চারা গজানোর পর প্রতি মাদার চারদিকে মাটির সঙ্গে চারা প্রতি ২-৫ গ্রাম অনুমোদিত দানাদার কীটনাশক মিশিয়ে গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে।