কোরবানির পশু কেনার আগে সঠিক নিয়ম এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। সঠিকভাবে কোরবানি পালনের জন্য ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যবিধির কিছু দিক রয়েছে, যা সবাইকে বিবেচনা করা উচিত। কোরবানির পশু কেনা, পালন, এবং কোরবানি করার বিষয়ে অনেক হাদিস রয়েছে, যা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।
কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“কোরবানির দিনে আদম সন্তানের কোনো কাজ আল্লাহর কাছে কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় নয়। কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম, এবং খুরসহ আসবে, এবং কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই আনন্দের সঙ্গে কোরবানি করো।”
— (তিরমিজি: ১৪৯৩)
কোরবানির পশু কেনার নিয়ম
কোরবানির পশু নির্বাচনের নির্দেশনাঃ হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“কোরবানির পশু চার প্রকার হতে পারবে না: অত্যন্ত দুর্বল চোখবিশিষ্ট পশু, মারাত্মক অসুস্থ পশু, খুব খোঁড়া পশু যে হাঁটতে পারে না, এবং অতিশয় ক্ষীণ বা রুগ্ন পশু।”
— (আবু দাউদ: ২৮০৯) মূল ভাবনা: কোরবানির জন্য পশু নির্বাচন করার সময় অবশ্যই সুস্থ ও নিরোগ পশু বেছে নিতে হবে।
পশুর প্রতি দয়া প্রদর্শন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করেছেন, তাই তোমরাও পশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। যখন তোমরা কোরবানি কর, তখন ভালোভাবে তা করো এবং পশুর কষ্ট কমানোর জন্য ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করো।”
— (মুসলিম: ১৯৫৫) মূল ভাবনা: কোরবানি করার সময় পশুকে কষ্ট না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোরবানির পশু নির্বাচন
কোরবানির পশু নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এবং এটি করতে হলে ইসলামি বিধান অনুযায়ী কিছু বিষয় অবশ্যই মেনে চলা উচিত। ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে কোরবানির পশু নির্বাচনের সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে তা নিচে বিস্তারিত দেওয়া হলো:
কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশুর ধরন নির্ধারণে ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, এবং উট কোরবানির জন্য বৈধ। ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে একজনের কোরবানি চলে, আর গরু বা উট সাতজন মিলে কোরবানি করতে পারেন। নিচে কোরবানির পশু কেনার আগে খেয়াল রাখার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দেওয়া হলো:
কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
কোরবানির পশু কেনার আগে তার শারীরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা একেবারে জরুরি। খেয়াল রাখুন:
- পশুর ত্বক উজ্জ্বল এবং চকমকপূর্ণ কিনা।
- পশুর চোখ পরিষ্কার এবং জীবন্ত কিনা।
- পশু যেন শ্বাস নিতে কোনো সমস্যা না করে।
- খোঁড়া, রোগগ্রস্ত, বা খুব দুর্বল পশু এড়িয়ে চলুন।
কোরবানির পশুর শরীরের সুস্থতা
প্রতিটি পশুর অংশ ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে, কারণ শরীরের কোনো অংশ যদি অকেজো বা অস্বাভাবিক হয় তবে কোরবানি করা অনুচিত:
- পশুর শিং, কান, এবং লেজ অক্ষত এবং সুস্থ কিনা।
- দাঁত ঠিক আছে কিনা এবং পশু প্রাপ্তবয়স্ক কিনা।
কোরবানির পশুর বয়স
কোরবানির জন্য পশুর নির্ধারিত বয়স পূর্ণ হওয়া অত্যন্ত জরুরি:
- গরু বা মহিষ: কমপক্ষে দুই বছর বয়সী হতে হবে।
- ছাগল বা ভেড়া: এক বছর বয়সী হতে হবে। তবে, ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছর না হলে ছয় মাস পূর্ণ হলে এবং দেখতে প্রাপ্তবয়স্ক হলে কোরবানি দেওয়া যেতে পারে।
- উট: পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে।
কোরবানি পশুর খাদ্যাভ্যাস
সুস্থ এবং ভালো মাংসের জন্য পশুর খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ:
- নিশ্চিত করুন পশু প্রাকৃতিক খাবার, যেমন ঘাস বা খড়, খায়।
- ক্ষতিকর রাসায়নিক খাদ্য ব্যবহার করা হয়েছে কিনা খোঁজ নিন।
কোরবানি পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদপত্র
অনেক বাজারে পশুর জন্য স্বাস্থ্য সনদ দেওয়া হয়। এসব সনদ যাচাই করা দরকার:
- স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অনুমোদনপত্র আছে কিনা।
- পশু অ্যানথ্রাক্স বা অন্যান্য বিপজ্জনক রোগ থেকে মুক্ত কিনা।
- পশুর শরীরে ক্ষত বা ফুলে থাকা স্থান রয়েছে কিনা দেখুন।
- পশু খাবার গ্রহণ করছে কিনা এবং শক্তিশালীভাবে হাঁটছে কিনা পরীক্ষা করুন।
পশুর ওজন এবং আকার
পশুর ওজন এবং আকার কোরবানির জন্য উপযুক্ত কিনা বিবেচনা করুন:
- বেশি মোটা পশু সবসময় ভালো নয়; স্বাস্থ্যকর ওজনের পশু কিনুন।
- পশু যেন পুষ্টিমান সম্পন্ন হয় এবং সহজে কোরবানি করা যায়।
- ওজন যন্ত্রের সাহায্যে যাচাই করে সঠিক দাম দিন।
- বাজারের ওজন স্কেলে প্রতারণা হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
কোরবানির পশুর দাম যাচাই
পশুর সঠিক মূল্য যাচাই করা প্রয়োজন:
- বাজারের তুলনামূলক দাম সম্পর্কে ধারণা নিন।
- একাধিক জায়গা থেকে দরদাম করে সবচেয়ে উপযুক্ত পশু কিনুন।
কোরবানির পশুর বাজার পরিচ্ছন্নতা
যে জায়গা থেকে পশু কিনছেন তার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন:
- পশুর বাজারে পর্যাপ্ত হাইজিন ব্যবস্থা রয়েছে কিনা।
- পশু কেনার সময় নিরাপত্তা বিধান মেনে চলুন।
কোরবানির পশুর পরিবহন ব্যবস্থা
পশু কেনার পরে তা পরিবহন করাও গুরুত্বপূর্ণ:
- পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবহার করুন।
- পশু যেন দীর্ঘ ভ্রমণে কষ্ট না পায় বা আহত না হয়।
কোরবানির অতিরিক্ত পরামর্শ
- পশু কেনার সময় একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সঙ্গে রাখুন।
- পশু ক্রয় করার আগে তা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করুন এবং নিশ্চিত হন যে এটি সুস্থ ও সক্রিয়।
- পশুর খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিক্রেতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে পশু প্রাকৃতিক খাদ্যে লালিত-পালিত হয়েছে।
কোরবানির গরু কেমন হওয়া উচিত?
কোরবানির ধর্মীয় নিয়ম
কোরবানির আগে ধর্মীয় রীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ:
- পশু কোরবানির সঠিক নিয়ম জানুন।
- আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করার প্রক্রিয়া বুঝুন।
অনুমোদিত পশুর হাট
কোরবানির পশু কেনার জন্য নির্ভরযোগ্য এবং সরকার অনুমোদিত বাজার নির্বাচন করা জরুরি। এটি নিশ্চিত করবে যে আপনি স্বাস্থ্য পরীক্ষিত এবং বৈধ পশু কিনছেন:
- পশুর হাট সরকারিভাবে অনুমোদিত কিনা যাচাই করুন।
- বাজারের হাইজিন ব্যবস্থা এবং পশু ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়ম মেনে চলা হয় কিনা নিশ্চিত করুন।
বিক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতা
বিশ্বাসযোগ্য বিক্রেতা থেকে পশু কেনা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে প্রতারণার আশঙ্কা কমে:
- পরিচিত বা বিশ্বস্ত বিক্রেতার কাছ থেকে পশু কিনুন।
- বিক্রেতার অভিজ্ঞতা এবং পশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞান যাচাই করুন।
পশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ
পশুর আচরণ তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়। পশু শান্ত এবং সতেজ কিনা দেখুন:
- পশু খুবই দুর্বল বা অলস হলে তা এড়িয়ে চলুন।
- হঠাৎ বিরক্তিকর আচরণ বা অস্বাভাবিক গতিবিধি আছে কিনা লক্ষ করুন।
কোরবানির পশুর দাঁতের অবস্থা
পশুর দাঁতের অবস্থা তার বয়স এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়:
- গরুর বয়স নিশ্চিত করার জন্য দাঁতের অবস্থান এবং ধরন পরীক্ষা করুন।
- প্রাপ্তবয়স্ক পশুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দাঁত থাকা প্রয়োজন।
পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি
কোরবানির পশু কেনা এবং পরিবহন করার সময় পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত:
- কোরবানির পর বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করুন।
- পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতন থাকুন।
কোরবানির পশুর মাংস সংরক্ষণ পরিকল্পনা
কোরবানির পর চামড়া এবং মাংস সংরক্ষণের পরিকল্পনা করা জরুরি:
- চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- মাংস বন্টন ও সংরক্ষণ সঠিকভাবে করার জন্য আগেই প্রস্তুতি নিন।
কোরবানির মাংস বণ্টনের নিয়ম
আল্লাহ বলেন:
“তাদের (কোরবানির পশু) মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া (ভক্তি) আল্লাহর কাছে পৌঁছে।”
— (সূরা আল-হাজ্জ: ২২:৩৭)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা নিজেদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ মাংস রেখে দাও, এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়স্বজনের জন্য দান করো, এবং এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দাও।”
— (আবু দাউদ: ২৮১৬)
মূল ভাবনা: কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে আত্মীয়স্বজন, গরিব-দুঃখী, এবং নিজের জন্য রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।